ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা জেলা। জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে সাতক্ষীরা জেলার উত্তরে যশোর জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে খুলনা জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। অবস্থানগত দিক দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে।
উচ্চতার দিকে বিবেচনা করলে এ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ ফুট উচুঁতে। সাতক্ষীরার মোট আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গ কিলোমিটার। জেলার সীমানা যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে তাতে উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। তবে এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব অংশে জনবসতি নেই। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনের (সুন্দরবন) ১৪৪৫.১৮ বর্গ কিলোমিটার সাতক্ষীরার অন্তর্গত।
সাতক্ষীরা জেলা ২টি পৌরসভা, ৭টি উপজেলা, ৮টি থানা, ৭৮ টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ১৪২৩টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলাও সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরা উপজেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর (দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা), তালা ও কলারোয়া।
এ জেলায় প্রায় ২০ লক্ষ ৭৯ হাজার ৮ শত ৮৪ জন মানুষের বসবাস (২০১৩ সালের তথ্যানুযায়ী)।
বর্তমানে সাতক্ষীরা খুলনা বিভাগের প্রশাসনিক অঞ্চল হলেও প্রথম থেকেই এটি খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বঙ্গোপসাগরের উপকূল এবং ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত এ অঞ্চলটি মানব বসতি গড়ে ওঠার আগে ছিল একটি বিস্তীর্ণ জলাভূমি। পরবর্তীতে মানব বসতি গড়ে ওঠে।
সাতক্ষীরা একদা রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোহর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী এ জেলার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায়। বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। এ জনবসতি প্রাচীনকালে খ্যাত ছিল বুড়ন দ্বীপ নামে। এর পাশে চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ, জয়দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপ খ্যাত ছোট ছোট ভূখন্ডের অবস্থান পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাস ও মানচিত্রে। ঠিক কোন সময় থেকে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয় তার বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে। তার ভারত আক্রমণের সময় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি নামের একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাটি ছিল এ রাষ্ট্রের অধীন।
আলেকজান্ডারের পর মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বুড়নদ্বীপ ছিল পুরভুক্তির অন্তর্গত। বুড়নদ্বীপ এ সমেয় পরিচিত ছিল খাড়িমল নামে। চন্দ্র বর্মণ খাড়ি অঞ্চল দখল করে নেন চতুর্থ শতকে। এর পর বৌণ্যগুপ্ত (৫০৭-৫২৫) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। সপ্তম শতকে শশাঙ্ক, ভদ্রবংশ, খরগোরাত ও লোকনাথ বংশ রাজত্ব করছিলেন এ জনপদে।
পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রি. ৬৩৪) যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত দিয়েছেন তাতে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সময়ের গঙ্গারিডি পুরবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, কজংগল, তাম্রলিপ্তি, সমতট প্রভৃতি নামে খ্যাত ছিল। ‘বর্তমানের সাতক্ষীরা জেলা এই সমতটেরই অংশ’। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় পাল ও বর্মণ রাজারা শাসন করেন বুড়নদ্বীপ। ১৩৯৯ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ইলিয়াস শাহের বংশের অধীনে।
১৮৬১ সালে যশোর জেলার অধীনে ৭টি থানা নিয়ে সাতক্ষীরা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৮৬৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অধীনে এই মহকুমার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮৮২ সালে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে সাতক্ষীরা খুলনা জেলার অর্ন্তভূক্ত একটি মহকুমা হিসাবে স্থান লাভ করে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়।
সাতক্ষীরা জেলার নামকরণের রয়েছে বিচিত্র ইতিহাস। রয়েছে একাধিক মতবাদও। প্রাচীনকালে এই জেলাকে বাগড়ী, ব্যাঘ্রতট, সমতট, যশোর, চূড়ন প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হতো।
সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মতবাদ অনুযায়ী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক কর্মচারী বিষুরাম চক্রবর্তী নিলামে চূড়ন পরগনা ক্রয় করে তার অর্ন্তগত সাতঘরিয়া নামক গ্রামে বাড়ি তৈরী করেন। তার পূত্র প্রাণনাথ সাতঘরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন করেন। ১৮৬১ সালে মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর ইংরেজ শাসকরা তাদের পরিচিত সাতঘরিয়াতেই প্রধান কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যেই সাতঘরিয়া ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মুখে ‘সাতক্ষীরা’ হয়ে যায়।
সাতক্ষীরা নামকরণের আরেকটি মত হলো একদা সাত মনীষী সাগর ভ্রমণে এসে একান্ত শখের বসে (মতানৈক্যে রান্নার উপকরণাদি না পেয়ে) ক্ষীর রান্না করে খেয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই সাতজন মনীষীর ‘সাত’ এবং তাদের রান্না করে খাওয়া ‘ক্ষীর’ এর সাথে ‘আ’ প্রত্যেয় যুক্ত হয়ে লোকমুখে ‘সাতক্ষীরা’ প্রচলিত হয়ে যায়।
সাতক্ষীরা নামকরণের সর্বশেষ যে মতবাদটি প্রচলিত রয়েছে সে অনুযায়ী সাতক্ষীরায় উৎপাদিত সাতটি বিখ্যাত জিনিসের নাম নিয়েই এ জেলার নামকরণ। পণ্যগুলো হচ্ছে- ওল, ঘোল, কুল, সন্দেশ, মাছ, আম ও গাছের চারা।
সাতক্ষীরা জেলা অর্থনীতিতে বরাবরই স্বনির্ভর। ব্রিটিশযুগ থেকেই উপঢৌকন হিসেবে চব্বিশ পরগণা (বর্তমানের সাতক্ষীরা) লাভের পর ব্রিটিশ বেনেরা নিজ স্বার্থেই সুন্দরবনের উন্নয়ন ও এতদাঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ফলে অচিরেই নানাবিধ কৃষিপন্য, গৃহপালিতপশু, লবনাক্ত ও মিষ্টি পানির মাছ এবং সুন্দরবনের কাঠ, মধু ও পশুর চামড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার তথা সাতক্ষীরার অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনের অব্যবহিত পূর্ব যুগে অবশ্য অবিভক্ত বাংলার উপকূলীয় জেলাগুলোতে কিছু লবণ শিল্প গড়ে ওঠার সংবাদ পাওয়া যায় ।
সাতক্ষীরার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো হলো- বড়দল, পাটকেলঘাটা, পারুলিয়া, আখড়াখোলা, আবাদের হাট, নওয়াবেকি, ঝাউডাঙ্গা, বুধহাটা, কলারোয়া, বসন্তপুর, কালিগঞ্জ, নকিপুর, নাজিমগঞ্জ, ভেটখালি, হবিনগর, হোগলা, বুড়িগোয়ালিনী, বাঁশতলা ইত্যাদি।
এছাড়া সাতক্ষীরায় রয়েছে কয়েকটি ফিস প্রসেসিং প্লান্ট, কোল্ড স্টোরেজ, আইস প্লান্ট, রাইস মিল, অটো রাইস মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, বেকারী, ইট ভাটা, বাঁশ ও বেতের দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, তাঁত, লবণ, গুড়, পাটজাত দ্রব্য ও মাছ প্রভৃতি বর্তমানে সাতক্ষীরা শিল্প বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।
সাতক্ষীরায় খামারের মধ্যে ৮৬ টি গবাদিপশু, ৩২২ টি পোল্ট্রি খামার, ৩০৪৬ টি মৎস খামার (মিঠা পানির), ৩৬৫০ টি চিংড়ি খামার, ৬৬ টি হ্যাচারি এবং ১ টি গরু প্রজনন কেন্দ্র আছে। চামড়া শিল্পেও সাতক্ষীরার অবদান রয়েছে।
মূলত মাছ চাষই সাতক্ষীরার অর্থনীতির মূল ভিত। বিশেষ করে চিংড়ি চাষ। সাতক্ষীরার দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মৎস চাষের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার চিংড়ি ঘের (মৎস খামার) রয়েছে। এসব ঘেরের বেশির ভাগেই বাগদা চিংড়ির চাষ হয় এবং বছরে ২২ হাজার মেট্রিক টনের মতো চিংড়ি উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপসহ বহিঃবিশ্বে রপ্তানিকৃত শতকরা ৭০ ভাগ চিংড়ি সাতক্ষীরা থেকে উৎপাদিত হয়। সাতক্ষীরার বাগদা ও গলদা চিংড়ি বিশ্বের অনেক জায়গায় হোয়াইট গোল্ড নামে পরিচিত। চিংড়ি চাষের জন্যে প্রয়োজনীয় মাছের পোনা বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও সংগ্রহীত হচ্ছে (সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় এবং শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ও নওয়াবেকির হ্যাচারি থেকে) যা পূর্বে মৎস চাষীদের শতভাগ নির্ভর করতে হতো কক্সবাজারের হ্যাচারীর উপর।
সাতক্ষীরার অর্থনীতি মাছ চাষ নির্ভর হলেও এ জেলায় বিভিন্ন প্রকার কৃষি পণ্য উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে ধান, পাট, গম, পান পাতা অন্যতম। ফলের মধ্যে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেপে, নারিকেল, লিচু, সফেদা, জামরুল, কদবেল, বরই এবং পেয়ারা ইত্যাদি। তাছাড়া সাতক্ষীরার আমের দেশে-বিদেশে অনেক সুনাম আছে। বাংলাদেশ থেকে সাতক্ষীরার আম সর্বপ্রথম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আমরুপালি আম এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ লিঃ সাতক্ষীরার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। ৩৩ একর জমির উপর গড়ে উঠা এ মিলটি দেশের অন্যতম লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। স্থানীয় ভাষ্যমতে ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর পরামর্শে দেশের লাভজনক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় তখন এ মিলটিও তার মধ্যে পড়ে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল এবং অর্থনীতির গ্রাফ ক্রম নামতে থাকেলে ১৯৯২ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খোলার চেষ্টা করা হলেও মিলটি এখনও বন্ধ আছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর ‘ভোমরা স্থল বন্দরের অবস্থানও সাতক্ষীরায়। ১৯৯০ সালে শুল্ক স্টেশন হবার পর ১৯৯৫ সাল থেকে এ বন্দরটি ‘ভোমরা স্থল বন্দর’ নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
প্রায় ৩০ একর জমির উপর শুল্ক স্টেশনটি অবস্থিত, ভোমরা স্থল বন্দর শুল্ক স্টেশন থেকে সরকার দৈনিক ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। ভোমরা স্থল বন্দর শুল্ক স্টেশন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত এ বন্দর থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯১৭ কোটি ৭১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩২ টাকা।
এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আনার, আপেল, আংগুর, মাল্টা, আম, টমেটো, সয়াবিন বড়ি, মেথি, মসলাসহ প্রায় ৮১ প্রকার পণ্য আমাদের দেশে আসে আবার আমাদের দেশ থেকে গার্মেন্টেসের জুট ও নারকেলের ছোবড়াসহ ১২ থেকে ১৪ প্রকার পণ্য ভারতে যায়।
ভোমরা বন্দরে বর্তমানে ৭০০ থেকে ১০০০ শ্রকিমের কর্ম-সংস্থান। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও ভোমরা স্থল বন্দর আজও পূর্ণাঙ্গ স্থল বন্দরের মর্যাদা পায়নি।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও সাতক্ষীরা জেলা বেশ উন্নত। স্বাক্ষরতারহার শিক্ষা প্রতিবেদন শিশু জরিপ ২০১০ অনুসারে এ জেলার মোট ৫৩.৩২ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। সাতক্ষীরার শিক্ষা কার্যক্রম চলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে।
সাতক্ষীরায় ১টি মেডিকেল কলেজ, ২টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪৪ টি কলেজ, ১৩৫টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৮৫টি মাদ্রাসা রয়েছে।
দেশের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া সকল আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে সাতক্ষীরার জনসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল তার মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা ছিল ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীন। পরবর্তীতে গড়ে ওঠা ৯ম আর ৮ম সেক্টরের সাতক্ষীরার ভোমরা ছিল প্রথম ক্যাম্প। সাতক্ষীরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ২টি গণকবর, ৬টি বধ্যভূমি, ৫টি স্মৃতিস্তম্ভ, ১টি স্মৃতিফলক ও ৩টি স্মরণি রয়েছে।
বহু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সাতক্ষীরার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রবাজপুর শাহী মসজিদ, জমিদার বাড়ি ও যশোরেশ্বরী মন্দির (শ্যামনগর), বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রমিক নম্বরের আবিষ্কারক খান বাহাদুর আহছান উল্লাহর মাজার-নলতা রওজা শরীফ (কালীগঞ্জ), ব্রিটিশ আমলের পৌরসভা (দেবহাটা) নীলকুঠি (দেবহাটা), মাইচম্পার দরগা (সাতক্ষীরা সদর), বৌদ্ধ মঠ (কলারোয়া), তেঁতুলিয়া মসজিদ (তালা), জমিদার হরিচরণের বাড়ি (শ্যামনগর), জাহাজঘাটা (শ্যামনগর), শতাধিক বছর আগের বটগাছ-‘বনবিবির বটগাছ’ (দেবহাটা), শ্যামনগর উপজেলার ঐতিহাসিক গোপালপুর স্মৃতিসৌধ, ইশ্বরীপুর হাম্মামখানা, জাহাজ ঘাটা হাম্মামখানা এবং তৎসংলগ্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ, ঝুঁড়িঝাড়া ঢিবি (তালা), দরবার স্তম্ভ, গোবিন্দ দেবের মন্দির ঢিবি, যীশুর র্গীজা (শ্যামনগর), শ্যাম সুন্দর মন্দির, কোঠাবাড়ির থান, ছয়ঘরিয়া জোড়াশিব মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, দ্বাদশ শিব মন্দির ও জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম।
সাতক্ষীরার চিত্তাকর্ষক ও দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আগের সারিতেই থাকবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কারণ সুন্দরবনে প্রচুর সুন্দরী গাছ জন্মায়। আরেকটি মতবাদ অনুযায়ী সুন্দরবনের নামকরণ ‘সমুদ্র বন’ বা ‘চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)’ (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্রের আধার সুন্দর বনে রয়েছে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ (১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসাব মতে)। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়াা, গরান এবং কেওড়া।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বিচিত্র জীববৈচিত্র্যের আধার বাংলাদেশের সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮ টি উভচর প্রাজাতির আবাসস্থল। ২০০৪ সালের হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবন ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল যা পৃথিবীতে বাঘের একক বৃহত্তম অংশ। যদিও সাম্প্রতিককালে বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
সুন্দরবনের আবেশে কেওড়া বাগানে গড়ে ওঠা আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের পরিচিতি এখন দেশজুড়ে। জোয়ার-ভাটায় রূপ পরিবর্তনকারী এই ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার ভ্রমণ পিপাসুদের সুন্দরবন দর্শনের আগ্রহ বাড়িয়েছে বহুগুণে।
সুন্দরবনের আরেক আকর্ষণ মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত। যার একদিকে সুন্দরবন, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি। প্রায় ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকত দর্শনার্থীদের পুলকিত করে তোলে নতুন করে। যা পর্যটকদের বার বার ডাকে সুন্দরবনে।
তবে, সুন্দরবনে আসা দর্শনার্থীদের আনন্দ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ক্যারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ, ক্যারাম মুরা পাখি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, কৈখালী সীমান্ত ও পাঁচ নদীর মোহনা, উড়ালমন আদিবাসী গ্রাম ও নৌকা ভ্রমণ সাইট এবং শিয়ালকুনি বনায়ন। রয়েছে আদিবাসী মুন্ডাদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি অবলোকনের সুযোগও।
সাতক্ষীরার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে, মোজাফফর গার্ডেন (সাতক্ষীরা সদর), বনলতা বাগান ও মিনি পিকনিক স্পট (কালিগঞ্জ), সুন্দরবন সংলগ্ন কলাগাছি পার্ক (শ্যামনগর), জাহাজমারি এ.বি পার্ক (কলারোয়া), লেক ভিউ ক্যাফে (সাতক্ষীরা সদর), মিনি সুন্দরবন (দেবহাটা), ভোমরা স্থল বন্দর (সাতক্ষীরা সদর)।
অসংখ্য গুণী মানুষের জন্ম সাতক্ষীরায়। যারা শুধু সাতক্ষীরাকেই নয় সমগ্র বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সুপরিচিত করেছে। তাদের অনন্য অবদান এবং কর্মদক্ষতার কারণে তারা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। এমন কয়েকজন গুণীজন হলেন- বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক, সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক খান বাহাদুর আহছান উল্লাহ, জাতীয় অধ্যাপক, বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খান, বিশ্ব বিখ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজী, বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা কবি আজিজুননেছা খাতুন, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কন্ঠশিল্পী ওস্তাদ শেখ মো. কাওছার আলী, কবি মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক কবি সিকান্দার আবু জাফর, একুশে পদক প্রাপ্ত সাহিত্যিক আনিস সিদ্দিকী, বিশিষ্ট সাংবাদিক তোয়াব খান, সাংবাদিক ও টিভি ব্যক্তিত্ব আবেদ খান, নাট্যকার মনোজ মিত্র, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম মহিলা পাইলট শাহরিন বিনতে আনোয়ার, গানের পাখি দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী নীলুফার ইয়াসমীন, বিশিষ্ট চলচিত্র অভিনেত্রী রানী সরকার, নাট্যশিল্পী, তারিক আনাম খান, নাট্যশিল্পী আফজাল হোসেন, নাট্যশিল্পী ফাল্গুণী হামিদ, সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাংবাদিক সৈয়দ দিদার বখত, চিত্র নায়ক আমিন খান, চিত্র নায়িকা মৌসুমী, চিত্র নায়িকা পরীমনি অভিনেত্রী মৌসুমী হামিদ, মডেল ও অভিনেত্রী সারিকা সাবরিন, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর এবং সর্বশেষ সাতক্ষীরাকে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কাটার মাস্টার খ্যাত ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান এবং ড্যাশিং ওপেনার সৌম্য সরকার।
সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে দৈনিক অধিকারের সাথে কথা বলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ডা.আ.ফ.ম রুহুল হক এমপি। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি আমাদের সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরার ইতিহাস-ঐতিহ্য, রূপ-লাবণ্য দেশের অন্য কোনো জেলার চেয়ে কম নয়। সাতক্ষীরা বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী একটি জেলা। যার আছে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। সাতক্ষীরার মানুষ অত্যান্ত সহজ-সরল এবং অতিথি পরায়ণ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাতক্ষীরা ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। সাতক্ষীরার চিংড়ি মাছ এখন বিশ্ব সমাাদৃত। সাতক্ষীরার প্রধান পর্যাটন কেন্দ্র সুন্দরবন। সাতক্ষীরায় একমাত্র জেলা যেখান থেকে সড়ক পথে সরাসরি সুন্দরবন দেখা যায়।’
সাতক্ষীরার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও উপকূল বিষারদ সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক জেলা-ই প্রাকৃতিক বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিতি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার গুরুত্ব ও সম্ভাবনাও কম নয়। সুন্দরবন ও সুদরবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র এবং ঐতিহাসিক নানা স্থাপনাকে ঘিরে এই জেলা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠছে বিশ্বব্যাপী।’
দেশের যেকোন প্রান্ত থেকেই সড়ক পথে সাতক্ষীরায় আসা যায়। সাতক্ষীরার অপরূপ রূপ, সবুজ-শ্যামলীমা ও পূরাকীর্তি পর্যাটকদের বিমুখ করবে না। বরং দেবে একরাশ সজিবতা ও উৎফুল্লতা। তাই নাগরিক জীবনের বিষাক্ত বাতাস, ক্লেদাক্ত কর্মময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আসতে পারেন সাতক্ষীরায়।
[…] সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা […]