চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্যে খাত বিপদে পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, চীনের পণ্য ব্যবহার করে না দেশে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক সব ঘরেই ব্যবহার হয় চীন থেকে আনা পণ্য। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে স্থবির চীনের জনজীবন। বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন; আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। খোলা হচ্ছে না নতুন ঋণপত্র। এমন অবস্থায় দেশে তৈরি হচ্ছে পণ্যের সংকট। ভোগ্যপণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। তবে, বিকল্প বাজারের খোঁজ করছে সরকার।
চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের মারাত্মক প্রাদুর্ভাবে স্থবির সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য। থমকে আছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন রয়েছে চীন। বাৎসরিক উৎসবের কারণে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে ছিল সরকারি ছুটি। তবে, করোনা ভাইরাস সংকটে সেই ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে আরও দশ দিন। চিন্তার কারণ এ সংক্রমণ যদি আরও বাড়ে, তাহলে উৎপাদন শুরু করা কঠিন হবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। পরিসংখ্যান বলছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর মধ্যে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। আর দেশটিতে আমদানি মাত্র ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চীন নির্ভরতায় বাংলাদেশের সামনে পণ্য সংকট দেখা দিচ্ছে, যা সামনের দিনগুলো আরও তীব্র হবে।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহকারী মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, চীন থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল বেশি আসে। এছাড়া ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে মশলা এবং ফলও আমদানি করে বাংলাদেশ। তাই আমদানি চীন নির্ভরশীলতায় রপ্তানিতে সংকট হলে বিশাল চাহিদার বাজারে পণ্যে সংকট তৈরি হতে পারে। তবে, চীন সক্ষম একটি দেশ। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমলে তারা দ্বিগুণ উৎপাদন করে চাহিদার জোগান দেয়ার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
দাম বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের : ভোক্তার অতি প্রয়োজনীয় পণ্য রসুন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, টিসিবির হিসাব বলছে, সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে এই পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। শুধু রসুনই নয়, বেড়েছে আদার দামও। কয়েক দিনে কেজিতে এই পণ্যের দাম বেড়েছে অন্তত ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। পেঁয়াজের সরবরাহেও টান পড়েছে। অর্থাৎ দেশে পেঁয়াজের সংকটকালীন সময়ে চীন থেকে আনা হয় পেঁয়াজ। আমদানিতে স্থবিরতা তৈরি হওয়ায় পেঁয়াজের বাজারেও সংকট তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ মশলাজাতীয় পণ্যের দামই তেজি। দেশীয় জোগান কম থাকায় আমদানি মাধ্যমে স্বাভাবিক রাখা হয় জোগান। আর আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গন্তব্য চীন। তবে দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতায় হু হু করে বাড়ছে দাম।
বিপদে পড়বে গার্মেন্ট খাত : চীন থেকে মোট আমদানিকৃত পণ্যের ৭০ শতাংশই টেক্সটাইল কাঁচামাল, বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি। বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে ঝুঁকিতে পড়বে স্থানীয় উৎপাদন। বিশেষ করে কাঁচামাল না এলে, পোশাক শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বিকল্প বাজার হচ্ছে ভারত : চীনের সংকটে গার্মেন্ট পণ্যের বিশাল চাহিদার বিপরীতে বিকল্প গন্তব্য হচ্ছে ভারত। গেল গত বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে টেক্সটাইল শিল্পে সংকট এবং সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নতুন প্লাটফর্ম গঠন করা হয়। যার নাম ‘বাংলাদেশ-ভারত টেক্সটাইল ফোরাম’। বৈঠকে বাংলাদেশ এবং ভারতের ব্যবসায়ীদের এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, ওভেনের ক্ষেত্রে প্রায় ৬০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হয়। তাই সংকটকালীন এ সময়ে বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, একক বাজার নির্ভরশীলতা ঠিক না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে গার্মেন্টের কাঁচামাল আমদানি করা গেলে উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন হবে না। এক্ষেত্রে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেনাপোল এবং মংলা বন্দরের কার্যক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
ঋণপত্র নিয়ে চিন্তায় ব্যাংক : চীন থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু নতুন করে খোলা হচ্ছে না ঋণপত্র। পুরনো এলসি নিষ্পত্তি নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছে ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মোহাম্মদ সামস উল ইসলাম বলেন, এলসি খোলার পর পণ্য আসতে বিলম্ব হলে ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, পণ্য না এলে ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়বে। তবে, সংকট সুরাহায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সংকটকে সুযোগ হিসেবেও কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। অনেক অর্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসার সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
Leave a Reply