জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠনের দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ যশোর জেলা কমিটির আয়োজনে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে সংগঠনটির যশোর জেলা কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ উদ্দিন আহম্মেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণ সভায় যশোর বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ যশোর জেলা শাখার সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য ও যশোর জেলা সহ-সম্পাদক কামরুল হক লিকু, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের জেলা কোষাধ্যক্ষ শফিকুর জালাল নান্নু, জেলা দপ্তর সম্পাদক কামরুজ্জামান রাজেস, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সহ-সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন ও জাতীয় ছাত্রদল যশোর জেলার অন্যতম নেতা মধুমঙ্গল বিশ্বাস প্রমুখ। সভাটি পরিচালনা করেন সহ-সাধারণ সম্পাদক এ্যাডঃ আহাদ আলী লস্কর।
সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রতাপউদ্দিন আহম্মেদ এর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা দালাল পুঁজি বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অন্যতম কান্ডারী। তিনি ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন, লঞ্চ লেবার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ- স্কপের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। তিনি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা- আইএলও- এর সঙ্গে সম্পর্কিত ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি অব ওয়ার্কার্স এডুকেশন- এনসিসিডব্লিউই- এর কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। তিনি নৌ-যানসহ এদেশেন সকল শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির আন্দোলনে ভূমিকা নিতে যেয়ে বুঝতে পেরেছিলেন শ্রমিক-জনতার মুক্তির জন্যই সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজন। তাই তিনি একটি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, বিশ্বব্যাপি চলমান ১২তম বছরে পড়া মন্দা থেকে বের হওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা একদিকে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের অর্থে উদ্ধার ও উদ্দীপক কর্মসূচী, কৃচ্ছতা সাধন, পরিমাণগত সহজীকরণ (QE) কর্মসূচীর নামে সংকটের বোঝা আরো বেশী বেশী করে জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে মজুরী, বেতন, পেনশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনকল্যাণ খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে ছাঁটাই, বেকারত্ব, করের বোঝা বৃদ্ধি করে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণকে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট, আরো দারিদ্র, অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করছে। শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব সুতীব্র হওয়া এবং একচেটিয়া পূঁজির তীব্রতর আক্রমণ মোকাবেলায় আমেরিকা, ইউরোপসহ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোসহ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক, যুবক, জনতা বিভিন্ন রূপে আন্দোলন, বিক্ষোভ-সমাবেশ, ধর্মঘট-সাধারণ ধর্মঘট তীব্রতর করে চলেছে। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাপি সংক্রামক করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর ফলে দেশে দেশে ব্যাপক আতঙ্ক ও অর্থনীতির অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে নৌ-যান, হোটেল, গার্মেন্টস, চাবাগান, ফার্মাসিউটিক্যালস, নির্মাণ ইত্যাদি শিল্প ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকসহ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, হাসপাতাল, ব্যাংক, অফিস-আদালতে পরিচ্ছন্নতাকর্মি, গ্রামের কৃষক তথা শ্রমজীবীদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, রক্ত-ঘাম ঝরা পরিশ্রমে মুনাফার পাহাড় গড়ে দেশের অর্থনীতি চালু রাখলেও নির্মম শোষণের যাতাকলে পিষ্ট এ জনগোষ্ঠী পায় না ন্যায্য মজুরি। দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠদের জীবন-জীবিকার সমস্যা আপামর জনগণের সমস্যার সাথে জড়িত। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক সংকট তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে চলমান করোনা ভাইরাস ও ডেঙ্গুর সংক্রমণের আশঙ্কার পরিস্থিতিতে গ্রামের কৃষক, শহরের শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনগণের কাজের ক্ষেত্র সংকচিত হয়ে পড়ায় বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণের সমস্যা-সংকট, শোষণ-লুণ্ঠন, দুঃখ-কষ্ট, নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণ হচ্ছে প্রচলিত নয়াউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। এর জন্য দায়ি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিকে উচ্ছেদ করা ছাড়া শ্রমিক-জনতার মুক্তি অর্জিত হতে পারে না। এই সত্যকে আড়াল ও অস্বীকার করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসক-শোষক গোষ্ঠী ও এনজিওরা শ্রমিক-জনতার মধ্যকার বিভক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে।
তারা আরো বলেন, আবার উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদে ফেলে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে চলেছে। বাংলাদেশের শ্রমিক-জনতাকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে তিন শত্রুকে উৎখাত করে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার, রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর করতে হবে। এ লক্ষ্যে পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে বেসরকারি মালিকানার শ্রমিক-কর্মচারিদের বর্তমান বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে বাঁচার মত ২০ হাজার টাকা নিম্নতম মূল মজুরির দাবিতে আন্দোলনকে অগ্রসর করতে হবে। আপসকামী দালাল নেতৃত্ব ছুড়ে ফেলে ত্যাগী, সৎ ও আপোসহীন নেতৃত্বে সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
প্রতাপউদ্দিন আহম্মেদের মৃত্যু, মৃত্যুতেই শেষ নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নতুন জীবনে তাঁর আদর্শের অরুণোদয় ঘটবে।
Leave a Reply