সংস্কার আর সংরক্ষণের অভাবে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪শ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন কলারোয়ার কোঠাবাড়ির থান। ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটির বেশিরভাগ অংশই ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। তবে কালের সাক্ষী হয়ে এখনও গাছপালা মাথায় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ। কোঠাবাড়ির থান সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলা শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে হেলাতলা ইউনিয়নে অবস্থিত।
কোঠাবাড়ির থান মূলত মোগল আমলে গড়ে উঠা একটি থান বা খানকা, যেটি বর্তমানে কোঠাবাড়ির থান নামে পরিচত। অনেকেই এটিকে কোঠাবাড়ির দরগা নামেও চেনেন। এর গঠনশৈলী থেকে ধারণা করা হয় এটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত হয়েছিল। সে সময় সম্রাটের কয়েকজন দেওয়ান এই কোঠাবাড়িতে একটি দুর্গ নির্মাণ করার কাজ করেন এবং রাজ্য রক্ষার জন্য সৈন্যদের নিয়ে এখানেই অবস্থান করতেন।
অবশ্য এই থান নিয়ে রয়েছে অনেক কুসংস্কার। অনেকেই বলেন একজন সিদ্ধ পুরুষ বা সাধু তার নিজের কবরের ওপর তার নিয়ন্ত্রিত জিনের দ্বারা এটি নির্মাণ করিয়ে নেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই যখন মোরগ ডেকে উঠে তখন তারা ভাবে সকাল হয়ে গেছে। তাই নির্মাণ কাজ শেষ না করেই চলে যায়। ১৯৩৭ সাল থেকে এখানে নামাজ পড়া এবং মানত করা শুরু হয়। পরবর্তীতে শুধু মুসলমান নয় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এখানে প্রার্থণা করতো বলে জানা যায়। বর্তমানে এখানে কেউ নামাজ না পড়লেও মনত চলছে আগের মতোই।
জানা গেছে, কোঠাবাড়ির থানের পাশেই ছিলো পাঁচটি বড় পাথর। এই পাথরগুলোর কারুকাজ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এটি কোনো পিলারের ভাঙা অংশ। কিন্তু সেই পাঁচটি পাথর এখন একটিতে দাঁড়িয়েছে। বাকিগুলোর খোঁজ নেই।
কলারোয়ায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কোঠাবাড়ি থান
এই থানের মূল দালানের পুরুত্ব প্রায় ছয়ফুট। এখানে ছিলো বেশকিছু টেরাকোটা ইট, যেগুলোতে পদ্মফুল, মানুষ, লতাপাতা, হাতিসহ বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকানো ছিল। এগুলো দেখে ইতিহাসবিদগণ সহজেই অনুমান করেন এটি মোঘল শাসনামলের কোনো সময়ে তৈরি। কিন্তু টেরাকোটা সেই ইটগুলোও আজ আর সেইভাবে চোখে পড়ে না। সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোও বিলীন হওয়ার পথে।
বর্তমানে প্রায় এই থান ধ্বংসাবশেষ অবস্থায় রয়েছে। থানের বিভিন্ন জায়গায় দেয়াল ভেদ করে কিছু বটগাছ রয়েছে। মূলত অনেককাল এটি লোকচক্ষুরর অন্তরালে ঢাকা ছিল। এটি আবিস্কারের পরে ১৯৩৭ সালের দিকে কুসংস্কারের বশিভুত হয়ে সকলে নামাজ পড়া ও মানত করা শুরু করে। বর্তমানে নামাজ পড়া বন্ধ হলেও মানতের প্রচলন রয়েছে। প্রতি শুক্রবার এখানে (থান) ‘মিসকিন মেলা’ এবং মানতকারীদের সমাবেশ বসে। বর্তমানে এই স্থানটি বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষিত স্থাপনা হিসাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ সংরক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি উন্মুক্ত হওয়ায় দর্শনার্থী এবং মানতকারীরা কখনো এর উপরে চড়ে আবার কখনো এখানে বিভিন্ন ইট-পাথরের টুকরা সুতা দিয়ে বেধে দেয়। কখনো আবার দেয়ালের উপর লেখালেখি করে।
স্থানীয় ইমরান হুসাইন জানান, কোঠাবাড়ির থান নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য শোনা যায়। এর সঠিক ইতিহাস সমৃদ্ধ কোনো সাইনবোর্ড যদি এখানে দেওয়া হয় তবে ভালো হয়। স্থাপনা নষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনাও সাইনবোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করলে এটি সংরক্ষিত হতে পারে।
তিনি আরও জানান, স্থাপনাটি ঘিরে একটি সীমানা প্রাচীর দিলেও সংরক্ষণের কাজে দেবে।
এ বিষয়ে প্রত্নত্তত্ব অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান বলেন, কোঠাবাড়ির থান প্রত্নত্তত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত স্থাপনার তালিকাভুক্ত। এটি সংরক্ষণে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, স্থাপনাটি সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কিত সাইনবোর্ড দেওয়ার বিষয়টিও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো।
Leave a Reply