বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের কারণ খুঁজতে গেলে শুরুতেই চোখে পড়বে কর্মমুখি শিক্ষার অভাব। যে শিক্ষা দ্বারা শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও কর্মের মধ্যে সমন্বয় ঘটে তাই কর্মমুখী শিক্ষা। এ শিক্ষায় বাস্তবিক জ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে।
পৃথিবীর সকল উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রাধান্য বেশি যার ফলে তাদের বেকারত্বের হার কম। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র বিপরীত। আমাদের দেশের অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষার বদলে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝোঁক বেশি। এজন্য উচ্চ শিক্ষার হার পরিমাণগত দিক দিয়ে বৃদ্ধি পেলেও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে চার শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব শ্রমশক্তি ধরে বিবিএস।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। দুই থেকে আড়াই লাখ যুব দেশের বাজারে নিজেদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারছেন। অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে প্রতি বছর গড়ে আট থেকে দশ লাখ যুবসমাজের কাজের সুযোগ পায়। অন্যরা অপ্রচলিত খাতে কাজ করেন। অনেকের হয়তো শেষ পর্যন্ত কাজের সুযোগই থাকে না। আর এই পরিস্থিতির জন্য কর্মমুখি শিক্ষার অপ্রতুলতা সবচেয়ে বেশি দায়ী।
কর্মমুখী শিক্ষা থাকলে একজন লোক প্রাত্যহিক জীবনে ছোটখাট কাজ সম্পাদনে নিজেই সচেষ্ট হতে শেখে এবং নিজ গৃহ থেকে শুরু করে, ক্ষেত-খামার, কল-কারখানাসহ সব জায়গায় উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান একটি দেশ। এ দেশের অর্থনীতি ও মূলত কৃষিভিত্তিক। কৃষি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক কারিগরি কৃষি শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির সার্বিক প্রয়োগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে যদি আমরা আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠিকে বিজ্ঞান ভিত্তিক কারিগরি কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারি তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, রাষ্ট্র খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির আত্বকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হবে।
কৃষিক্ষেত্রে অথবা যেকোন টেকনিক্যাল কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে একজন যুবক খুব সহজেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে আত্মনির্ভশীল করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সে আরো অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে পারে। অথচ কঠিন সত্য হলো অনেক উচ্চ শিক্ষিত যুবক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতো দূরে থাক নিজের বেকারত্ব নিয়ে হতাশাগ্রস্থ।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় স্নাতক শেষ করে চাকরির সন্ধানে থাকা যুবক নূর হুসাইনের সাথে। হতাশার সুর নিয়ে তিনি বলেন, স্নাতক শেষ করে গত দুবছর ধরে বিভিন্ন চাকরির আবেদন করে যাচ্ছি। এখনো পর্যন্ত ভালো কোন কাজের সাথে যুক্ত হতে পারিনি। এখন একটি অনলাইন প্লাটফর্মের হয়ে হোম ডেলিভারির কাজ করছি পাশাপাশি ভালো চাকরির সন্ধানে আছি।
কর্মসংস্থানের সংকট মোচনের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত ও কারিগরি শিক্ষা অর্থাৎ কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বত্তোম ব্যাবহার করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ২০, ৩০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার মো. হেলালে হায়দার বলেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেকার জীবন যাপন করে অথচ কারিগরি শিক্ষায় তাদের আগ্রহ কম। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সবাই ভাবে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করলে ভালো সরকারি অথবা বেসরকারি চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ গ্রাজুয়েট দেশের কর্মবাজারে প্রবেশ করে সে পরিমাণ চাকরির সুযোগ থাকে না এজন্য প্রতিবছর বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে তবে তাদের সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগতো থাকেই সাথে-সাথে সে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এতে করে তার কর্মসংস্থান নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক বেকারের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
Leave a Reply