পরিচয়: ফাতিমা আল-ফিহরির জন্ম আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন ফেজ নগরীর খ্যাতিমান ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর মেয়ে। দ্বিতীয় ইদরিসের শাসনকালে পরিবারসহ তিনি ফেজ নগরীতে বসবাস করতেন।
ভাগ্যের অন্বেষণে পিতা মুহাম্মদ আল-ফিহরি ফাতিমার জম্মের কয়েক বছর পর ফেজে আসেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সন্তানদের জন্য তিনি সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফাতিমা আল-ফিহরি এবং তার বোন মারিয়াম আল-ফিহরি ক্লাসিকাল আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিক্হ এবং হাদিস শাস্ত্রের উপর পড়াশোনা করেন।
দারিদ্র ও অভাবীদের অত্যাধিক সহযোগিতার কারণে তিনি সবার কাছে ‘উম্মুল বানিন’ তথা সন্তানদের মাতা নামে পরিচিত ছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইয়াসির হিলালি উল্লেখ করেন, সম্ভবত অত্যাধিক সাহায্যের কারণে তাঁর এ উপনামটির উদ্ভব হয়েছে। আর বাস্তবেই তাঁর তত্ত্বাবধানে অনেক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করত।
যেভাবে বৃহৎ মসজিদ নির্মাণ হলো: পিতা ও স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ লাভ করেন তিনি। এ বিশাল অর্থ দিয়ে তিনি মুসলিমদের জন্য ফেজ নগরীতে একটি বড় মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা করেন। জমি ক্রয় করে ২শ ৫৪ হিজরির (৮৫৯ খ্রি.) প্রথম রমজান থেকে তাতে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন।
দশম শতাব্দি থেকে কারাউইন মসজিদটি মুসলিমদের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উত্তর আফ্রিকার সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্ঞানী-গুণী ইসলামি শিক্ষাবিদদের আগমন ঘটে। এখানে নিয়মিত বিতর্ক অনুষ্ঠান ও সেমিনার-সেম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হত।
পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়: কারাউন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ইউনেস্কো এবং গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী এটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা এখন পর্যন্ত একাধারে এখনও চালু আছে। প্রাথমিকভাবে এটি মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে শিক্ষা কার্যক্রমও চালু থাকে। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি টিম্বাকটুতে অবস্থিত সংকর মসজিদ (৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত)-এর প্রায় শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া ইটালির বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় (১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত)-এর দুই শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী: অনেক বিশ্বখ্যাত মনীষী এখানের শিক্ষার্থী ছিলেন। ইসলামি আইনজ্ঞ, ফকিহ, হাদিস গবেষক, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীসহ জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখার জ্ঞানীরা এখানে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানী আবদুর রহমান ইবনে খালদুন, দর্শনের জনক আবু ওয়ালিদ ইবনে রুশদ, আন্দালসুর চিকিৎসক মুসা বিন মায়মুনু ও অরিল্যাকের জারবার্ট।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিমদের পাশাপাশি মধ্যযুগের অনেক খ্যাতিমান ইহুদি এবং খ্রিস্টান মনীষীও এখানে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পোপ দ্বিতীয় সিলভাস্টার ছিলেন এখানের অন্যতম শিক্ষার্থী। যিনি এখান থেকে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি বিষয়ে ধারণা লাভ করে সেই জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দেরকে প্রথম শূন্যের (০) ধারণার সাথে পরিচিত করেছিলেন।
কারাউইন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটিকেও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগুনে পুড়ে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও এখনও এতে প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন এবং দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে।
মৃত্যু: ফাতিমা আল-ফিহরি ইন্তেকাল করেন ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাউইন মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিগত হাজার বছরে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জন করে বেরিয়েছে।
সম্মাননা ও বৃত্তি: ২০১৭ সালে তিউনিসিয়ায় ফাতিমা আল ফিহরির স্মরণে একটি সম্মাননা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর নারীদের প্রশিক্ষণ ও নানা পেশায় দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগের জন্য এ পুরস্কারটি দেওয়া হয়। এছাড়াও ফাতিমা আল ফাহরির স্মরণে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন একাডেমিক প্রোগ্রাম ও বৃত্তি দেওয়া হয়।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে
Leave a Reply