রাজধানীতে বাসাবাড়ি ও রেস্তোরাঁর বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশেষ চক্র। চক্রটি অনেকটাই জিম্মি করে রাজধানীবাসীর পকেট কেটে বছরে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এদিকে জুলাই বিপ্লবের পর এই বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলাকাভিত্তিক গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এরা কোনো না কোনো দলের সমর্থন নিয়ে তাদের ব্যবসা করছে। তাদের ওপর দুই সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই।
জুলাই বিপ্লবের আগে দীর্ঘ ১৫ বছর এ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত আওয়ামী লীগের লোকজন।
তারা এখন কোণঠাসা। আবার অনেকে এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন। এর পরিবর্তে ময়লা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে নতুন গ্রুপ ও মুখ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
জুলাই বিপ্লবের পর রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ২ নম্বরে ময়লা বাণিজ্যের দখল নিয়ে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত ১১ জানুয়ারি ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে গুলশান যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনিসের নেতৃত্বে প্রতিপক্ষ স্বপন ক্লিনিং সার্ভিস গ্রুপের ভ্যানচালক সবুজকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হামলায় জড়িত আনিস ও দুর্জয় মাস্টার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। রাজুর লোকজনও এ হামলায় জড়িত ছিল। তারা সবাই যুবদলের নেতাকর্মী।
স্বপন গ্রুপের দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরাও বিএনপি করি। কিন্তু আনিস গ্রুপ শত শত লোক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আমাদের ওপর হামলা করায় আমরা টিকতে পারিনি। গত জানুয়ারির শেষ নাগাদ তারা সম্পূর্ণ গুলশান-বাড্ডা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
দেলোয়ারের ভাষ্যমতে, শুধু গুলশান এলাকা থেকেই প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকার মতো ময়লার বিল আদায় হয়। এভাবে নগরীতে মাসে অন্তত ১০ কোটি এবং বছরে শতকোটি টাকার মতো বাণিজ্য হয়। আর এ বাণিজ্য লাভজনক হওয়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ভাই ভাই ক্লিনিং সার্ভিসের হান্নান সরদার দুর্জয় ওরফে দুর্জয় মাস্টার বলেন, কারো ওপর হামলা করার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আগে যারা ময়লা নিত, তারা সবাই টোকাই আনোয়ারের লোক। এ ছাড়া তারা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির লোক। তারা এলাকায় মদ-গাঁজার ব্যবসা করত। ফলে এলাকাবাসীই তাদের তাড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্যের অধিকাংশই বাসা-রেস্তোরাঁ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বাসাবাড়ি বা রেস্তোরাঁ থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেই। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা রাস্তার পাশে ময়লা রাখার ঘর বা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করেন। এই সুযোগে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপ। বর্জ্য সংগ্রহ করে কনটেইনার কিংবা এসটিএস পর্যন্ত নিয়ে যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি ময়লা আমিনবাজার ও মাতুয়াইলের ভাগাড়ে নিয়ে যায়।
ঢাকার দুই সিটিতে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে হোল্ডিং রয়েছে তিন লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫টি। অধিকাংশ হোল্ডিংয়ে ছয় থেকে ১২টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে ময়লা বিল বাবদ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা; অভিজাত এলাকায় আদায় করা হয় ৫০০ টাকা করে।
এদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সরাসরি বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে। এজন্য নগরবাসীকে আলাদা কোনো টাকা দিতে হয় না। কিন্তু রাজধানীতে প্রতিটি বাসা বা ফ্ল্যাটের জন্য সিটি করপোরেশন নির্ধারিত মাসিক ৩০ টাকার কয়েকগুণ বেশি আদায় করছে চক্রের সদস্যরা।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও প্রতি বছর গৃহকরের ৩ শতাংশ নেয় পরিচ্ছন্নতা বাবদ। গত অর্থবছরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ১৫০ কোটি টাকার বেশি পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করে। অথচ তারা বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ না করে বিভিন্ন সময় দলীয় নেতাকর্মীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, আইন অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহের সুযোগ সিটি করপোরেশনের রয়েছে। নগরবাসী মনে করে, দুই সিটি করপোরেশন চাইলেই রাজধানীর বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে এমন বাণিজ্য বন্ধ করতে পারে।
গুলশান এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার জাহিদ বলেন, সরকারে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তাদের স্বার্থ থাকায় কাজটি হচ্ছে না। যে যেভাবে পারছে ময়লা বিল বাড়িয়ে দিচ্ছে, প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিচ্ছে। এর নিয়ন্ত্রণ দরকার। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত নিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ ফি নির্ধারণ করা উচিত।
জানা যায়, বেসরকারিভাবে বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত আছে। তবে এসব সংগঠনের বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই।
আবার সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত নয় এমন অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের মতে, নিবন্ধিত সংগঠনের বাইরে আরো দুই শতাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন বর্জ্য সংগ্রহ করে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত দুই ধরনের সংগঠনই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলের লোকেরা।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, রাজধানীতে সাত হাজারের বেশি রেস্তোরাঁ রয়েছে। প্রতিটি রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে এই টাকার পরিমাণ আরো অনেক বেশি। সাত হাজার রেস্তোরাঁ থেকে মাসে আদায় হচ্ছে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। বছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এই টাকাটা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার সক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। তাই বেসরকারি সহায়তা নেওয়া হয়। সংগ্রহকারীরা এলাকাভেদে কোথাও ১০০, আবার কোথাও ৩০০ টাকা নিচ্ছে। অবশ্যই এটি নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। জুলাই বিপ্লবের পর দুই সিটিতেই নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এ বি এম সামসুল আলম বলেন, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে আমিনবাজার ভাগাড়ে নিয়ে যায়। বাসাবাড়ি ও রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব কমিউনিটি সার্ভিসের। এ ছাড়া অন্য কোনো কিছু ফোনে বলতে রাজি নন তিনি।
Leave a Reply