বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কক্সবাজার ও নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকার। তবে এর মধ্যে শুধু ঐসব শিক্ষার্থীদের টিফিনে কলা, বনরুটি ও বিস্কুট খাওয়াতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশন।
এছাড়া প্রকল্পটি শিক্ষার্থীদের নাচ-গানের জন্য ১৪ কোটি ও মনোসামাজিক উন্নয়নের জন্য ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করে তোলা। কিন্তু মোট ব্যয়ের ৩৯ শতাংশ টিফিন খাওয়ানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে।
তারা আরো জানান, সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে টিফিন খাওয়ানোর জন্য এরই মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বড় একটি প্রকল্প রয়েছে। তা হলে এ প্রকল্পে এত টাকা ব্যয়ের প্রয়োজন কী? এ বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এদিকে জানা গেছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি যেকোনো প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বাধ্যবাধকতা থাকলে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প ব্যয় হলেও তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি।
এর আগে টিফিন খাওয়ানোর যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেটারও সম্ভাব্যতা যাচাই না করে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়। পরে একনেক সভা থেকে প্রকল্পটি বাদ দেওয়া হয়।
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে ৬৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং ৪৫৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। প্রকল্পটি ফেব্রুয়ারি ২০২৭ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর।
প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য-কক্সবাজার এবং বান্দরবান জেলার ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ধরে রাখা ও শিক্ষার উন্নতির জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় মিড-ডে মিল পাইলটিং করা, বিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে নির্বাচিত বিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণ এবং আসবাবপত্র সরবরাহের মাধ্যমে উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি।
প্রকল্পের লক্ষ্য দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ লাখ ২৬ হাজার শিশু বিভিন্ন কম্বিনেশনে (ফার্টফাইড বিস্কুট, কলা/মৌসুমি ফল, বন, ডিম, ইউএইচটি দুধ) বিদ্যালয়ে খাবার গ্রহণের সুযোগ পাবে। ১ হাজার ৯৪টি বিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় করার জন্য নির্বাচিত বিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণ এবং আসবাবপত্র সরবরাহের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এক হাজার ৯৪টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, হাইজিন পণ্য সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান এবং শিশুদের উচ্চতা-ওজন-দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। ১ হাজার ৯৪টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য সরঞ্জাম প্রদান করা হবে। উপজেলা/জেলা শিক্ষা অফিসের জন্য আইটি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সরঞ্জাম প্রদান, নির্বাচিত ৫০টি বিদ্যালয়ে স্মার্ট স্কুল বিষয়ক পাইলটিং সফটওয়্যার প্রণয়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ, স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট এবং শিক্ষকদের উপস্থিতির জন্য সরঞ্জাম প্রদান। উদ্বুদ্ধকরণ কর্মশালায় বিভিন্ন পর্যায়ে ১ হাজার ৯৪টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এসএমসি সভাপতি, উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের মনিটরিং অফিসাররা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবেন।
কক্সবাজার ও ভাসানচরের ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা ও মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের অনুমোদনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ৩০০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যমান ৩০০০ লার্নিং সেন্টার সংস্কার করা। সহায়তা প্রাপ্ত লার্নিং সেন্টারে ২ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর আগমন ঘটবে, যার অর্ধেক মেয়ে। একটি শিক্ষাচক্র সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা আড়াই লাখ হবে। এর মধ্যেও অর্ধেক মেয়ে থাকবে। আয়োজন করা মনোসামাজিক ইভেন্টের সংখ্যা হবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১০০।
প্রকল্পটি নেয়ার বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় পাহাড় ও প্রত্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে। এ রকম জায়গায় শিক্ষার অভিগম্যতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও এসব এলাকার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী বৈচিত্র্যপূর্ণ শিক্ষা সফলভাবে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিবান্ধব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ এলাকাগুলো বিশেষ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করায় শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আদিবাসী এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীসহ পাহাড়ি এলাকাগুলোয় পিছিয়েপড়া এবং স্বল্প সুবিধাভোগী জনসাধারণ বসবাস করে। পাহাড়ি এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নেও অবদান রাখছে, যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মোট এক হাজার ৯৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ হাজার ২৯৭ জন শিক্ষক এবং ২ লাখ ১৫ হাজার ৪১৩ জন ছাত্রছাত্রী উপকৃত হবে। বিভিন্ন পটভূমির শিশুদের একত্রে বিদ্যালয়ে আনার ফলে তা এ এলাকাগুলোয় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিপুলসংখ্যক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ এবং ৩১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত অর্থায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে এটি একটি অন্যতম প্রকল্প।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষার্থীদের টিফিনে কলা-রুটি, ডিম-রুটি, বিস্কিট-কলা, অন্যান্য ফল দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাঁচ দিন পাঁচ ধরনের টিফিন দেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, প্রকল্পটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এটি পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই করবে। কাটছাঁট হবে। এরপর এটি একনেক সভায় অনুমোদন পেলে তখন কার্যক্রম শুরু হবে। যেহেতু এখনো প্রস্তাব পর্যায়ে আছে সে জন্য এ বিষয়ে বেশি কথা বলছি না।
Leave a Reply