জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে ১৯৬৬-৬৮ সালে নিজের কারাবাসের ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন তিনি। কারাগারে বসে লেখা এই ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধু কখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে তারিখ উল্লেখ করে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন, আবার কখনও দু’একদিন বাদ দিয়ে লিখেছেন। কোথাও আবার কয়েক দিনের ঘটনা একত্রে বর্ণনা করেছেন। যেমনটি রয়েছে ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবলির বর্ণনা।
‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি যে সময়কার ঘটনা নিয়ে রচিত, সে সময় বঙ্গবন্ধু টানা এক হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। তিনি ৬৬ সালে ৮ মে গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। সেই দফায় গ্রেফতার হওয়ার ২৫ দিন পর ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে এই ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। এরপর টানা ৭ আগস্ট পর্যন্ত তারিখ ধরে ধরে লেখাগুলো এ বইয়ে স্থান পেয়েছে। পরে ধারাবাহিকতার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মাসখানেক পর আবার সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে থেকে শুরু হয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেখা স্থান পায়। এর সাড়ে তিন মাস পর ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা লিপিবদ্ধ করা আছে। তবে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এককভাবে উল্লেখ করেছেন। ওই দিনের ঘটনায় তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। এর বাইরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হকের (বাকী) জামিন পাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে তিনটি বাক্য লিখেছেন।
এদিকে এই দফায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে থাকলেও ডায়েরিতে সর্বশেষ রয়েছে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারির দিককার ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে জেলের ভেতরে লেখার খাতা না পাওয়ার প্রসঙ্গও উল্লেখ রয়েছে কারাগারের রোজনামচা বইয়ে, যার কারণে লেখার ধারাবাহিকতা না থাকার প্রসঙ্গও এসেছে।
‘২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭। ৮ই ফাল্গুন’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর তাঁর ডায়েরিতে সেদিন লিখেছেন, তা হলো—
‘‘আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান: ১। আবদুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এইদিনে আমিও জেলে রাজবন্দি ছিলাম, ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করবো, আর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলো। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।
আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।
প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।
১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দীন (তখন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘোষণা করলেন, পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা হতে প্রস্তাব পাস করাইবেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে। সকল বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই। ১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইনসভার সামনে লাঠিচার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে। ২১শে মার্চ বা দুই-একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ছাত্ররা তাঁর সামনেই কনভোকেশনে প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনদিন ভাষার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বৎসর ১১ই মার্চকে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরিক হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালে ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে।’ তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো।
আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ, ২১শে থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়হা, নঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরো অনেকে গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।
তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল।
এই দিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল, তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে, বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে এই দিনটি সরকারি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটা চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলো।
আমি কারাগারের এই ছোট্ট ঘরটি থেকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই বাংলার যুব সমাজ ও জনসাধারণকে, আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।’’
২১ ফেব্রুয়ারির ডায়েরির শেষাংশে তিনি লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক (বাকী) জামিন পেয়ে এতদিন জেলের বাহিরে যেতে পারে নাই। আজ সকালে তাকে কোর্টে পাঠাইয়া দিয়েছে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেয়ে শহীদ দিবস পালন করছে।’
Leave a Reply