দুই বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও খুলনার ভৈরব সেতুর কাজ সাড়ে তিন বছরেও শেষ হয়নি। দীর্ঘ এই সময়ে মাত্র ১৩ শতাংশ কাজ হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সেতুর দুই পাড়ের মানুষজন। কবে কাজ শেষ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা অজুহাত দেখিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সব জটিলতা নিরসন করে আগামী দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করবে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর।
সওজ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভৈরব নদের দুই পাড়ের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর একনেকে পাস হয়। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ১ দশমিক ৩১৬ কিলোমিটার। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। বাকি টাকা সেতু-সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় হবে। ২০২০ সালের ২৭ জুলাই নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করে সওজ। প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার ছয় মাস পর ২০২১ সালের ২৪ মে কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কার্যাদেশ অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে আরও দেড় বছর। সেইসঙ্গে কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ওই মেয়াদ অনুযায়ী আগামী ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এত বছরে দিঘলিয়া প্রান্তে ৯টি খুঁটি (পিয়ার) আর শহর প্রান্তে দুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজের অগ্রগতি ১৩ শতাংশ। এ অবস্থায় তৃতীয় দফায় আরও দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় দফার সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে স্থানীয়দের সংশয়। কারণ যেভাবে কাজ চলছে, তাতে আরও কয়েক বছর লাগতে পারে।
প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, সেতুর পিয়ার বসবে ৩০টি। এর মধ্যে শহর অংশের কুলিবাগান থেকে রেলিগেট (ভৈরব নদের তীর) পর্যন্ত ১ থেকে ১৪ নম্বর পিয়ার এবং সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে ১৭ থেকে ২৮ নম্বর পিয়ার বসবে। রেলিগেট প্রান্তে নদের পাড় থেকে ৪২ মিটার ভেতরে ১৫ নম্বর এবং দিঘলিয়া প্রান্তে নদের পাড় থেকে ১৮ মিটার ভেতরে ১৬ নম্বর পিয়ার বসবে। দুটি পিয়ারে সেতু বসার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ১১টি পিয়ারের কাজ শেষ হয়েছে। দিঘলিয়া প্রান্তে কাজ চলমান থাকলেও অপর প্রান্ত রেলিগেট থেকে দৌলতপুর মুহসিন মোড় পর্যন্ত নির্মাণকাজ থমকে আছে। এই প্রান্তে সেতু নির্মাণের জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা অধিগ্রহণ করা হলেও স্থাপনা সরানো হয়নি। এখনও জায়গা বুঝে পায়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এদিকে, কাজে ধীরগতির কারণে নদ পারাপারে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের। তারা জানিয়েছেন, গত সাড়ে তিন বছরে নানা অজুহাতে কাজ বন্ধ ছিল পাঁচ বার। এতদিনে সেতু দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল। অথচ পিয়ার বসানো-ই হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বশীদের গাফিলতির কারণে কাজ শেষ হচ্ছে না।
সেতুর কাজ শেষ না হওয়ায় চলাচলে স্থানীয়দের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে উল্লেখ করে দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ মোল্লা বলেন, ‘ভৈরব সেতু এই অঞ্চলের প্রাণের দাবি। যত দ্রুত সম্পন্ন হবে ততই এলাকার মানুষ উপকৃত হবে। এলাকার উন্নয়ন জোরদার হবে।’
যাতায়াতে দুর্ভোগের কথা জানিয়ে দিঘলিয়ার সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আসিফ আলতাফ বলেন, ‘সেতুটি খুলনাসহ এই অঞ্চলের মানুষের সহজ যোগাযোগের জন্য অন্যতম। স্বপ্নের এই সেতু বাস্তবায়নে ঢিমেতালের কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। কাজের গতি বাড়ানো প্রয়োজন। বছরের পর বছর কেটে যায়, কাজ শেষ হয় না। আর শেষ হয় না আমাদের ভোগান্তি। কবে শেষ হবে, তাও কেউ জানে না।’
দিঘলিয়ার পাটশ্রমিক রবিউল ইসলাম মিশু বলেন, ‘এই সেতু নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।’
কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপক এসএম নাজমুল হোসেন বলেন, ‘সেতুটির কাজ শুরু করতে দেরিতে হয়েছে আমাদের। জমি বুঝে পেতেও সময় লেগেছে। শহর প্রান্তের জমি বুঝে পাইনি এখনও। ফলে স্বাভাবিক গতিতে কাজ করতে পারছি না। আগামী ৩০ জুন দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে। তাই নতুন করে দুই বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছি। অনুমোদন পেলে এই সময়ের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।’
কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য নকশায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে এসএম নাজমুল আরও বলেন, ‘তাতে মূল সেতু কংক্রিটের বদলে স্টিল দিয়ে করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এই প্রস্তাব অনুমোদন হলে কাজ দ্রুত শেষ হবে।’
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল উল্লেখ করে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘দিঘলিয়া প্রান্তে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিয়েছি। শহর প্রান্তে আমরা জমি বুঝে পাওয়ার জন্য শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবো। এ ছাড়া রেলওয়ের সঙ্গে আমাদের জমি হস্তান্তর কার্যক্রম অনেকটা এগিয়েছি। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরও ধীরগতি রয়েছে। কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা সেই গতিতে কাজ করেনি। বারবার সতর্ক করেছি। গতি না বাড়ালে ব্যবস্থা নেবো।’
সর্বশেষ গত ১৩ মে দুপুরে ভৈরব সেতুর দিঘলিয়া প্রান্ত পরিদর্শন শেষে কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় হতাশার কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মসিউর রহমান। নির্মাণকাজের অগ্রগতি হতাশাজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেতুর বর্তমান নকশায় কম গতির যানবাহন চলাচল করলে যানজটের আশঙ্কা আছে। নদে পিয়ার স্থাপনে ন্যাবতা সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। সড়ক বিভাগ বলছে, তারা স্টিল স্ট্রাকচারে যাবে নাকি কংক্রিট স্ট্রাকচারে যাবে; তা এখনও বিবেচনায় আছে। স্টিল ব্রিজে গেলে নদের নাব্যতা বেশি দিন রাখা সম্ভব হবে। স্টিল ও কংক্রিট স্ট্রাকচারে খরচের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। তবে এত বছরেও এই কাজ শেষ না হওয়া দুঃখজনক।’
Leave a Reply