ক্ষয় ধরেছে মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছে

মুশফিকুর রহমান (রিজভি)
  • আপডেটের সময় : শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯
  • ৩৭১
কলারোয়ার মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছ

পুরাকীর্তি প্রেমীদের জন্য এক অনন্য আকর্ষণ মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছ। এর অসামান্য নির্মাণশৈলী শুধু পুরাকীর্তি প্রেমীদেরই নয় মন কাড়বে সবার। তাই তো প্রায়শই ‘মঠবাড়ি’ পরিদর্শনে আসেন বিভিন্ন এলাকার সৌন্দর্য প্রেমীরা, আর উপভোগ করেন এ মন্দিরগুচ্ছের অপরূপ সৌন্দর্য।

মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছ সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে ৯.৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির অবস্থান। মূলত পাশাপাশি তিনটি মন্দিরের অবস্থান হওয়ায় এটিকে মন্দিরগুচ্ছ বলা হয়।

এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর তিন তলাবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। এটিই ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এ মন্দিরটির তিনতলা ভবনের বিশেষ বৈশিষ্ঠ হচ্ছে ভবনটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়নি কোন রড সিমেন্টের ঢালাই। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির।

এই মঠের মূল ভবনের গা ঘেঁষে পশ্চিমের মন্দিরের ছাদ ও দেওয়ালের অংশবিশেষ ধসে পড়েছে। পূর্ব দিকে ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন করে শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেন্টিমিটার/ ৩ ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। তবে এখনকার পুরোহিত জানিয়েছেন এখানে প্রথম পর্যায়ে যে শিবলিঙ্গ ছিল সেটি চুরি হয়ে গেছে। মূল মঠের দক্ষিণে রয়েছে আর একটি ধসে পড়া ভবনের অংশবিশেষ। যার কোন সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নি।

ভবনে ব্যবহৃত ইটে খোদাই করা লেখার বেশিরভাগ স্থান ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে যেটুকু লেখা অবশিষ্ট আছে তা এখনকার মত বাংলা অক্ষর নয়। কিছু শব্দ বর্তমান বাংলার মত হলেও অনেক অক্ষর একেবারে বোঝা যায় না। এটিকে বাংলা হরফের আদি রূপ বলে স্থানীয় ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব শিক্ষকরা মনে করেন। আর হরফের এই রূপ দেখে এর নির্মাণকাল ৪/৫শ বছর আগে কেউবা ৭/৮শ বছর আগে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক মো. মোশারফ হোসেন তার ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সতীশ চন্দ্র মিত্র তার বইয়েও একই কথা উল্লেখ করেছেন।

এই মঠের বিশেষত্ব হচ্ছে এর তিনতালা ভবনের ছাদ কোন রড, সিমেন্টের ঢালাই বা কড়ি বর্গা ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। মঠের মূল ভবনের নীচতলায় ১৪ কুঠুরি এবং দ্বিতীয় তলায় ১৪ কুঠুরি। তৃতীয় তলায় রয়েছে ৭ কুঠুরি। আড়াই বর্গ হাতের এসব ক্ষুদ্রাকৃতির কুঠুরি নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এসব কুঠুরির মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে অন্ধকোটা। অন্ধকোটায় এত অন্ধকার যে দিনের বেলায়ও কিছুই দেখা যায় না। দিনের বেলায়ও আলো ছাড়া এ ঘরে প্রবেশ বিপদজনক। অন্ধকোটার মধ্যস্থলে ছিলো কূপ। যেখানে পড়ে গেলে জীবন্ত ফেরার সম্ভাবনা থাকেনা। কিন্তু বর্তমানে সে কূপ ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণামুখী এই মন্দিরের নিচের তলার ভেতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা বারান্দা। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মিটার/২০ ফুট-২ ইঞ্চি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মিটার/৪ ফুট-৫ ইঞ্চি চওড়া একটি মণ্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে কক্ষ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পেছনে রয়েছে একটি বারান্দা, যেখানে দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল।

দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণামুখী কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মিটার/৭ফুট-৬ ইঞ্চি x ১.৯৮মিটার/৬ ফুট-৬ ইঞ্চি। মন্দিরের তৃতীয় তলার ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে।

শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেন্টিমিটার/১ ফুট-৬ ইঞ্চি উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ন রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’।

এই মন্দিরগুচ্ছের দক্ষিণে একটি দিঘি আছে। কথিত আছে দিঘিটিতে একসময় একটি নৌকা বাঁধা থাকতো। তবে এখন সে নৌকার দেখা মেলেনা।

মঠের চূড়ায় একটি বজ্র নিরোধক দণ্ড আছে। দণ্ডটির সাথে পাশের দীঘির পানির নীচের মাটিতে একটি সংযোগ শিকল ছিলো। সে শিকলটি এখন আর নেই। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির চতুর্দিকে আরও মন্দির ছিল বলে শোনা যায়। এরকম বেশ কিছু ধ্বংসস্তূপ পাশে দেখা যায়। কিন্তু মঠের মূল ভবনের উপর গাছপালা লতাগুল্ম জন্মেছে। ক্ষয় শুরু হয়েছে। ভবনটির অসংখ্য স্থানে ফাটল ধরেছে। তবে এই ধ্বংসস্তূপটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে খুবই গুরুত্ব বহন করছে।

মন্দিরের পূজারী রমাপ্রসাদ চৌধুরী বলেন, এক সময় ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ এসে এই মঠে অবস্থান করেন। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি পবিত্র মন্দির। এজন্য বিপদজনক হয়ে পড়া মঠ ভবনের পাশে টিনশেড নির্মাণ করে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পূজা অর্চনা করে আসছে।

কলারোয়ার ঐতিহাসিক এ স্থাপনাকে ঘিরে অনেক কুসংস্কারও প্রচলিত আছে। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন মন্দির এবং সামনের দীঘিটি রাতারাতি অলৌকিকভাবে নির্মিত হয়েছে। মন্দির পরিদর্শনে আসা রূপা রানী এমনটিই জানালেন। তিনি বলেন, আমি শুনেছি মন্দিরটি এক রাতেই নির্মিত হয়েছে।

মন্দিরগুচ্ছ সংরক্ষণে একটি সীমানা প্রাচীর অতীব জরুরি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রবীণ পুরোহিত সুপ্রসাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মন্দিরটিতে কোন সীমানা প্রাচীর না থাকায় এখানে জনগণের অবাধ বিচরণ। অনেক উগ্রপন্থীরা মাঝে-মাঝে মন্দিরটির ক্ষতি সাধন করে। এখানে সীমানা প্রাচীর দেওয়া জরুরি। এছাড়া আমরা যাতে এখানে নির্বিঘ্নে পূজা-অর্চনা করতে পারি সে ব্যবস্থা করা দরকার।

সোনাবাড়িয়া সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আখতার আসাদুজ্জামান বলেন, ঐতিহাসিক মঠবাড়ি মন্দিরগুচ্ছ আমাদের এলাকা তথা পুরা দেশের একটি বিশেষ পরিচিতি। এর অনেক অংশ ক্ষয় হয়ে গেছে। কিছু কিছু অংশ ধসে পড়েছে। আমরা একাধিকবার একাধিক জায়গায় মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার কাজের জন্য আবেদন জানিয়েছি। বিগত কয়েক বছর আগে এখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিদর্শনে আসে এবং স্থাপনাটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে আমরা ভেবেছিলাম এবার হয়তো মন্দিরটির সংস্কার হবে। কিন্তু আজ অবধি মন্দির সংস্কারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। মন্দিরগুচ্ছের মূল নকশা ঠিক রেখে সংস্কার করা জরুরি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০২১
Design and Developed by IT Craft in association with INTENT